সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
আজহারুল হক॥
হায়দার আকবর খান রনো একটি নাম। একটি ইতিহাস। বাংলাদেশের একজন কমিউনিষ্ট নেতা। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। অসাম্প্রদায়িক চিন্তাকে ধারণ করে আজীবন কাজ করেছেন। পুর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের একজন খ্যাতনামা বুদ্ধা হিসেবেই রাজনীতির অঙ্গনে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিলো। তিনি ছিলেন মার্কসবাদের তত্ত্বের প্রবক্তা। বাংলাদেশে যে কয়জন সাচ্ছা কমিউনিষ্ট ছিলেন। তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। প্রবীণ রাজনীতিক ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো শুক্রবার দিবাগত রাত ২টায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারে। তার আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
কাছে থেকে দেখা একজন কমিউনিষ্ট: ৯৫ সালের শুরুর দিকে আমি বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হই। বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি জনতার লড়াই সংগ্রামের আরেক পুরোধা খন্দকার আলী আব্বাস। তার সান্নিধ্যে এসেই প্রথম রনো ভাইকে কাছে পাই। তখন তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি করতেন। পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। সংগঠনের প্রশিক্ষণ বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে রনো ভাই ছিলেন শ্রেণী সংগ্রামের তাত্ত্বিক গুরু। মার্কসবাদ লেনিনবাদের নানা প্রয়োগিক বিষয়ে তিনি আমাদের জ্ঞান দানে বা এ আর্দশের প্রতি অনুগত হতে উৎসাহ যোগাতেন। রনো ভাই ছিলেন একজন নির্লোভ ও মুক্তমনা মানুষ। মার্গীয় চিন্তা চেতনার আদর্শের ধারক এ মানুষটিকে দেখে সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল হতাম।
হাসিখুশি প্রানবন্ত স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী। তাকে কখনো রাগতে দেখিনি। বা কারো সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলতেও দেখা যায়নি। আগাগোড়াই একজন ভদ্র মার্জিত ও সম্ভ্রান্ত বলে মনে হতো। রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে আমরা তরুণরা যখন রাগ অভিমান করতাম তখন তিনি হেসে দিয়ে কাছে ডেকে তার স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে আমাদেরকে সাংগঠনিক বিষয়ে বুঝিয়ে দিতেন। তার কাছে রণনীতি রণকৌশল ও শ্রেণী সংগ্রামের বিষয়ের পাঠদানে মুগ্ধ হতাম। কমরেড অমল সেন, ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল মতিন, খন্দকার আলী আব্বাস, পরেশ সাহা, শ্রমিক নেতা আবুল বাসার প্রয়াত আরো অনেক বর্ষীয়ান কমিউনিষ্ট নেতাদের কাছে পেয়েছি। কিন্তু রনো ভাই ছিলেন এক ভিন্ন ধারার মানুষ। কোনো লোভ লালসা তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। মৃত্যুর পুর্বে অনেক প্রবীণ কমিউনিষ্ট আর্দশচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু রনো ভাই ছিলেন তার ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক আপোষকামীতায় তিনি কখনো পছন্দ করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার ক্ষুদ্র জীবনে কাছে থেকে অনেক কমিউনিষ্ট নেতাকে দেখেছি। কিন্তু হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন সাবলীল চিন্তার মানুষ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেক নেতাই বুর্জোয়া শ্রেণীল লেজুরবৃতি করেছেন। নানা সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এমপি মন্ত্রী হওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি।
রনো বলতেন ‘আমরা কমিউনিষ্ট। আমরা অন্য জাতের মানুষ। বিশে^র শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে কখনো আপোষ করবো না”। তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে কখনোই পরোয়া করেননি। তার আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রকাশ করছি। কমরেড রনো ভাইয়ের স্ত্রী হাজেরা সুলতানাও আজীবন সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর জীবনাবসানে এদেশের কমউিনিষ্ট আন্দোলনে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। স্বচ্ছ ভাব ধারার বামপন্থীরা কখনোই তাকে ভুলতে পারবে না। তাকে অনুসরণ করে সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আজকের নবীন কমরেডদের এগিয়ে আসতে হবে। যদিও আজকে আর আগের মতো ত্যাগী নির্লোভ ও আর্দশিক কর্মী তৈরী হচ্ছে না। বর্তমান নেতৃত্বকে তাদের স্বার্থগত রাজনৈতিক বলয় থেকে বেরিয়ে কমরেড অমল সেন, কমরেড মতিন, কমরেড আলী আব্বাস ও কমরেড রনোর আর্দশ প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। রনো ভাইয়ের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রত্যাশাই হোক আগামী দিনের রাজনীতির রণনীতি রণকৌশল।